ঢাকা ০২:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৪ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ভারতের টেলিভিশনে যা চলছে, তাতে খবর কম, নাটক বেশি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:০২:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ মে ২০২৫
  • / ৩৬৮ বার পড়া হয়েছে

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত সন্দেহে দুই যুবকের বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়

৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বসে আছি আদিলের বাড়িতে। আদিল ঠোকার। পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় এই আদিল যুক্ত ছিল বলে সন্দেহ নিরাপত্তারক্ষীদের। শাস্তিস্বরূপ মাঝ রাতে আইইডি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি। প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে ওই ভাঙা বাড়ির দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে বসে আছেন আদিলের মা শাহজাদ। আর তাকে ঘিরে বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার। একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে। তাদেরই মধ্যে একজন আচমকা শাহজাদকে প্রশ্ন করে বসলেন, ”বাড়িটা যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আপনার কেমন লাগছিল?” প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকা চোখটা একবার কেবল কেঁপে উঠল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে শাহজাদ বললেন, আদিল যদি সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে এই শাস্তি তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করছেন।

এরপর আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন শাহজাদ, কিন্তু তার আগেই মুহূর্তের মধ্যে শাহজাদের ওই কথাটি নিয়ে শুরু হয়ে গেল টেলিভিশন লাইভ। ঠিক যেমন হচ্ছিল আরেক আদিলের বাড়িতে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে পর্যটকদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন আদিল শাহ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার শরীর। লিডার নদীর ধারে আদিলদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে বসে আছেন তার বাবা। বাইরে মিডিয়া চ্যানেলের ভিড়। একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে যাচ্ছে সকলে, ”আদিলের মৃত্যুর পর ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে?” একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন আদিলের বাবা– ”দুখ ভি হ্যায়, ফকর ভি হ্যায়।” ফকর, অর্থাৎ গর্ব। আর ওই একটিই বাক্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা দিন ধরে তার মুখ দিয়ে বলিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। আদিলের বাবা যতবার নিজের জন্য সময় চাইছেন, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ততই ঘিরে ধরছে তাকে। জাপটে ধরছে।

এই রিপোর্টাররাই এই মুহূর্তে গোটা কাশ্মীর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিয়মমাফিক দৈনিক কনভয়ের ছবি দেখিয়ে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করছেন। সেনা বাহিনীর বহু ব্যবহৃত ক্যান্টার দেখিয়ে বলছেন, আধুনিক ট্যাঙ্ক। ঝিলাম কিংবা সিন্ধ নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন সিন্ধু নদী। যে নদীর জলবন্টন এখন দুই দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের অন্যতম কারণ এখন। শুধু তা-ই নয়, সীমান্তে দাঁড়িয়ে ভুয়ো সংঘাতের গল্প শোনাচ্ছেন তারা।

ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে পহেলগামে। কিন্তু ওই ঘটনা ঘিরে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ যা করছে, তা আরো ভয়াবহ। ভুয়ো খবরের বন্যা বইছে টেলিভিশন জুড়ে। অসত্য তথ্যের স্রোত বইছে সমাজ মাধ্যমে। যা দেখে মানুষ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।

আবার একটি ঘটনার কথায় ফিরে আসা যাক। উরি সেক্টরে লাইন অফ কন্ট্রোলের এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছানো গেছিল। ডয়চে ভেলে ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল আরো বেশ কিছু মিডিয়া। যার মধ্যে বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। উরি সেক্টরে প্রতিদিনই প্রায় গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু তা সীমান্ত পারাপার করছে না। এই ঘটনা সিস ফায়ার চুক্তি লঙ্ঘন করছে সন্দেহ নেই। তবে সীমান্তের মানুষ জানেন, কোন সংঘাত কেমন হয়। এখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নন। তাদের আশঙ্কা এমনটা যদি চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। শেলিং হলে তাদের বাড়ি ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও তাদের আছে। কিন্তু এখনো সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, প্রকাশ্যে বলছেন তারা। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ওই এলাকার কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন সীমান্ত পার করে গুলি এসে পড়ছে পায়ের গোড়ায়। চূড়ান্ত নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং করা হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে কার্যত ওই রিপোর্টিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

আবার এই রিপোর্টাররাই পহেলগামে ঘটনাস্থলের ছবি লাইভে দেখিয়ে দিচ্ছেন। দেখিয়ে দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর অভিযানের ছবি। এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২৬/১১ মুম্বই হামলার ঘটনা। লাইভ টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল এনএসজি অভিযানের ছবি। যে খবর সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছিল সন্ত্রাসীদের কাছে। ঠিক সেই একই কাণ্ড আবার ঘটতে দেখলাম পহেলগামে।

গণমাধ্যমের কাজ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু গণমাধ্যম যখন খবর তৈরি করতে শুরু করে, খবর তখন আর খবর থাকে না, নাটকে পরিণত হয়। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলির একটি বড় অংশ এখন ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। তৈরি হচ্ছে বিভেদ।

জনপ্রিয় কে না হতে চায়? কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, তা শুধু চিন্তার নয়, ভয়ের। আর এই ভয়ই ক্রমশ গ্রাস করছে ১৪০ কোটির একটি দেশকে। এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।

প্রতিবেদন: স্যমন্তক ঘোষ

নিউজটি শেয়ার করুন

ভারতের টেলিভিশনে যা চলছে, তাতে খবর কম, নাটক বেশি

আপডেট সময় : ১২:০২:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ মে ২০২৫

বসে আছি আদিলের বাড়িতে। আদিল ঠোকার। পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় এই আদিল যুক্ত ছিল বলে সন্দেহ নিরাপত্তারক্ষীদের। শাস্তিস্বরূপ মাঝ রাতে আইইডি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি। প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে ওই ভাঙা বাড়ির দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে বসে আছেন আদিলের মা শাহজাদ। আর তাকে ঘিরে বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার। একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে। তাদেরই মধ্যে একজন আচমকা শাহজাদকে প্রশ্ন করে বসলেন, ”বাড়িটা যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আপনার কেমন লাগছিল?” প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকা চোখটা একবার কেবল কেঁপে উঠল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে শাহজাদ বললেন, আদিল যদি সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে এই শাস্তি তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করছেন।

এরপর আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন শাহজাদ, কিন্তু তার আগেই মুহূর্তের মধ্যে শাহজাদের ওই কথাটি নিয়ে শুরু হয়ে গেল টেলিভিশন লাইভ। ঠিক যেমন হচ্ছিল আরেক আদিলের বাড়িতে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে পর্যটকদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন আদিল শাহ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার শরীর। লিডার নদীর ধারে আদিলদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে বসে আছেন তার বাবা। বাইরে মিডিয়া চ্যানেলের ভিড়। একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে যাচ্ছে সকলে, ”আদিলের মৃত্যুর পর ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে?” একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন আদিলের বাবা– ”দুখ ভি হ্যায়, ফকর ভি হ্যায়।” ফকর, অর্থাৎ গর্ব। আর ওই একটিই বাক্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা দিন ধরে তার মুখ দিয়ে বলিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। আদিলের বাবা যতবার নিজের জন্য সময় চাইছেন, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ততই ঘিরে ধরছে তাকে। জাপটে ধরছে।

এই রিপোর্টাররাই এই মুহূর্তে গোটা কাশ্মীর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিয়মমাফিক দৈনিক কনভয়ের ছবি দেখিয়ে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করছেন। সেনা বাহিনীর বহু ব্যবহৃত ক্যান্টার দেখিয়ে বলছেন, আধুনিক ট্যাঙ্ক। ঝিলাম কিংবা সিন্ধ নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন সিন্ধু নদী। যে নদীর জলবন্টন এখন দুই দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের অন্যতম কারণ এখন। শুধু তা-ই নয়, সীমান্তে দাঁড়িয়ে ভুয়ো সংঘাতের গল্প শোনাচ্ছেন তারা।

ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে পহেলগামে। কিন্তু ওই ঘটনা ঘিরে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ যা করছে, তা আরো ভয়াবহ। ভুয়ো খবরের বন্যা বইছে টেলিভিশন জুড়ে। অসত্য তথ্যের স্রোত বইছে সমাজ মাধ্যমে। যা দেখে মানুষ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।

আবার একটি ঘটনার কথায় ফিরে আসা যাক। উরি সেক্টরে লাইন অফ কন্ট্রোলের এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছানো গেছিল। ডয়চে ভেলে ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল আরো বেশ কিছু মিডিয়া। যার মধ্যে বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। উরি সেক্টরে প্রতিদিনই প্রায় গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু তা সীমান্ত পারাপার করছে না। এই ঘটনা সিস ফায়ার চুক্তি লঙ্ঘন করছে সন্দেহ নেই। তবে সীমান্তের মানুষ জানেন, কোন সংঘাত কেমন হয়। এখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নন। তাদের আশঙ্কা এমনটা যদি চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। শেলিং হলে তাদের বাড়ি ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও তাদের আছে। কিন্তু এখনো সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, প্রকাশ্যে বলছেন তারা। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ওই এলাকার কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন সীমান্ত পার করে গুলি এসে পড়ছে পায়ের গোড়ায়। চূড়ান্ত নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং করা হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে কার্যত ওই রিপোর্টিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

আবার এই রিপোর্টাররাই পহেলগামে ঘটনাস্থলের ছবি লাইভে দেখিয়ে দিচ্ছেন। দেখিয়ে দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর অভিযানের ছবি। এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২৬/১১ মুম্বই হামলার ঘটনা। লাইভ টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল এনএসজি অভিযানের ছবি। যে খবর সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছিল সন্ত্রাসীদের কাছে। ঠিক সেই একই কাণ্ড আবার ঘটতে দেখলাম পহেলগামে।

গণমাধ্যমের কাজ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু গণমাধ্যম যখন খবর তৈরি করতে শুরু করে, খবর তখন আর খবর থাকে না, নাটকে পরিণত হয়। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলির একটি বড় অংশ এখন ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। তৈরি হচ্ছে বিভেদ।

জনপ্রিয় কে না হতে চায়? কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, তা শুধু চিন্তার নয়, ভয়ের। আর এই ভয়ই ক্রমশ গ্রাস করছে ১৪০ কোটির একটি দেশকে। এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।

প্রতিবেদন: স্যমন্তক ঘোষ