ঢাকা ০১:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ভিসানীতি আসলে কী জন্য!

চিররঞ্জন সরকার
  • আপডেট সময় : ০৬:১৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ৪০২ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা বিধিনিষেধ কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যখন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে, তখন মার্কিন ভিসানীতি দেশের ভাবমূর্তির জন্য আঘাত। রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই নতুন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। একে সুষ্ঠু নির্বাচনের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছেন। যদিও আমেরিকার এই ভিসানীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই নতুন মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে বলে আমেরিকা জানিয়েছে। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিয়মতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করার উদ্দেশ্যেই মার্কিন এই ভিসানীতি। আরও স্পষ্টভাবে বললে বাংলাদেশে যারা ‘বর্তমান অবস্থা’ বহাল রাখতে চায়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্যই মার্কিন ভিসার কড়াকড়ি।

প্রশ্ন হলো, এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আদৌ কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করবে? নাকি এটা আমেরিকার দাদাগিরি? বাংলাদেশকে কব্জায় রাখার নতুন কৌশল? এমনিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মার্কিন নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সমালোচনা আছে বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ ও নীতি প্রয়োগ নিয়ে।

পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে জোর করে অপসারণ করা হয়। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং একটি সম্পূর্ণ অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে, প্রায় এক দশকের সামরিক শাসনের পর, সম্প্রতি গণতন্ত্রীরা নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাদের ক্ষমতায় আসতে দেয় না। বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে এসব অগণতান্ত্রিক ঘটনা ঘটছে, কিন্তু আমেরিকা তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেনি। তারা এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে, কারণ তাদের অগণতান্ত্রিক সরকার তাদের স্বার্থ পূরণ করে।’

ইতিহাস ঘাটলে আমেরিকার গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর অহরহ নজির পাওয়া যাবে। এশিয়ার মানুষের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কিংবা অভিজ্ঞতার কোনোটিরই কমতি নেই। ১৯৭১-এ আমেরিকার নিন্দনীয় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যা, ১৯৭৫ সালে সিআইএর পরোক্ষ মদদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়ায় যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা, ইন্দোনেশিয়ায় সক্রিয়ভাবে সুহার্তকে সহযোগিতা করে গণহত্যার পটভূমি রচনা করা, লাতিন আমেরিকায় গণবিরোধী ভূমিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের কুখ্যাতি সম্ভবত অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, জেনারেল অগাস্টো পিনোশে সিআইএর ব্যাপক সমর্থনে ১৯৭৩ সালে চিলির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে উৎখাত এবং হত্যা করে।

আবার আরব বসন্তের ফুলঝুরি ছিটিয়ে আরব দেশগুলোতে নিজেদের পাপেট সরকার প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা কার্পণ্য করেনি। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসিকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের পছন্দের জেনারেল সিসিকে ক্ষমতায় বসায় তারা। নিজেরা মুখে মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র-শাসিত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহ বেশি তাদের। আমেরিকা তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতাকে না দেখার ভান করে, আবার কারও ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতার কিছু সত্য, তার চেয়েও বেশি অসত্য তথ্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়।

সেই আমেরিকা যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়, সেই উদ্যোগের উদ্দেশ্য নিয়ে তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে। যারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করবে, প্রভাবিত করবে, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হয়, এমন নির্দেশ দেবে, যারা সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে, তারা সবাই নাকি মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। কিন্তু ‘নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি’ প্রমাণিত হবে কীভাবে? আমেরিকা কাউকে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টিকারী সাব্যস্ত করলেই কি তিনি কথিত দোষে দুষ্ট হয়ে যাবেন? নাকি আমাদের বিচার বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত এতে বিবেচ্য হবে? নাকি আমাদের নির্বাচন কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত এতে কার্যকর হবে? নির্বাচনে পর্যবেক্ষণকারী এনজিওগুলোর এতে কী ভূমিকা থাকবে? তাদের কোনো পর্যবেক্ষণ কি কাউকে বাধা সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় ফেলবে? ভিসানীতি অনুসারে বাধা সৃষ্টিকারী সাব্যস্তের মোডাস-অপারেন্ডি কী হবে? যারা আমেরিকার ভিসা চাইছে না, জীবনেও আমেরিকা যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে না-এমন কিছু বা অনেক লোক কি নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টি করতে, বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না? যদি পারে, তাহলে সেখানে আমেরিকা আমাদের তেমন নির্বাচনকে কীভাবে দেখবে? তাদের ক্যাপিটল হিলে যে ট্রাম্পের সমর্থক হাজারো লোক উঠে গেল, তেমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারে না? তেমন কিছু ঘটলে এর বিরুদ্ধে ভিসানীতি কী কাজে আসবে?

তা ছাড়া সম্প্রতি নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডার ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতি কি আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে?

ভিসানীতির পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে? ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। অতীত ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দেয়, কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোতে আমেরিকার প্রথমে থাকে নিজের স্বার্থের প্রাধান্য। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যদি বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম অ্যাজেন্ডা হয়ে থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ববাদী রাজার শাসনাধীন দেশগুলোর জন্য কেন ভিসানীতির ঘোষণা আসে না? খুনের দায়ে অভিযুক্ত সৌদি যুবরাজ কীভাবে মার্কিন আনুগত্য পান?

এই ভিসানীতি যে বিশেষ মতলব থেকে করা, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। ভিসানীতি প্রয়োগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং অনধিকার চর্চা। বিষয়টিকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবেও দেখা যায়। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর। এই ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর কোয়াডে যুক্ত হওয়ার, মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সমঝোতা, জিসোমিয়া এবং আকসা চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে।

নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বিষয় নয়। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সামনে রেখে দেওয়া আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ঘোষিত উদ্দেশ্য যত মধুর শোনাক না কেন, এর অঘোষিত ও আসল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধে প্রবেশ করেছে আমেরিকা। আর এ বিরোধকে আমেরিকা গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের লড়াই হিসেবে চিত্রিত করছে, যা কিনা সততার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।

নিষেধাজ্ঞা কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, কিউবার ওপর ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও আমেরিকা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় কিউবা অনেক ধনী রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বিবিসি বাংলার খবর বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে।

তা ছাড়া, হুমকি দিয়ে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, ভীতি প্রদর্শন বা জোর করে কখনো কোনো দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না। বিশ্বের মোড়ল দেশটি এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য যে ভিসানীতি প্রয়োগ করছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটা কাউকেই সুবিধা দেবে না। বরং লেখাপড়া, ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি কিনে যারা আমেরিকায় বসতি গড়েছেন, কিংবা যারা বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেই এলিটদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা উদ্বেগ ও জটিলতা তৈরি করতে পারে।

সুষ্ঠু নির্বাচন রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার। সব দল চাইলে তা সহজেই সম্ভব। এ ব্যাপারে ভিসানীতি খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।

-লেখক ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

ভিসানীতি আসলে কী জন্য!

আপডেট সময় : ০৬:১৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গত ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা বিধিনিষেধ কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যখন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে, তখন মার্কিন ভিসানীতি দেশের ভাবমূর্তির জন্য আঘাত। রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই নতুন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। একে সুষ্ঠু নির্বাচনের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছেন। যদিও আমেরিকার এই ভিসানীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই নতুন মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে বলে আমেরিকা জানিয়েছে। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিয়মতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করার উদ্দেশ্যেই মার্কিন এই ভিসানীতি। আরও স্পষ্টভাবে বললে বাংলাদেশে যারা ‘বর্তমান অবস্থা’ বহাল রাখতে চায়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্যই মার্কিন ভিসার কড়াকড়ি।

প্রশ্ন হলো, এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আদৌ কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করবে? নাকি এটা আমেরিকার দাদাগিরি? বাংলাদেশকে কব্জায় রাখার নতুন কৌশল? এমনিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মার্কিন নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সমালোচনা আছে বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ ও নীতি প্রয়োগ নিয়ে।

পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে জোর করে অপসারণ করা হয়। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং একটি সম্পূর্ণ অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে, প্রায় এক দশকের সামরিক শাসনের পর, সম্প্রতি গণতন্ত্রীরা নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাদের ক্ষমতায় আসতে দেয় না। বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে এসব অগণতান্ত্রিক ঘটনা ঘটছে, কিন্তু আমেরিকা তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেনি। তারা এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে, কারণ তাদের অগণতান্ত্রিক সরকার তাদের স্বার্থ পূরণ করে।’

ইতিহাস ঘাটলে আমেরিকার গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর অহরহ নজির পাওয়া যাবে। এশিয়ার মানুষের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কিংবা অভিজ্ঞতার কোনোটিরই কমতি নেই। ১৯৭১-এ আমেরিকার নিন্দনীয় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যা, ১৯৭৫ সালে সিআইএর পরোক্ষ মদদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়ায় যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা, ইন্দোনেশিয়ায় সক্রিয়ভাবে সুহার্তকে সহযোগিতা করে গণহত্যার পটভূমি রচনা করা, লাতিন আমেরিকায় গণবিরোধী ভূমিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের কুখ্যাতি সম্ভবত অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, জেনারেল অগাস্টো পিনোশে সিআইএর ব্যাপক সমর্থনে ১৯৭৩ সালে চিলির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে উৎখাত এবং হত্যা করে।

আবার আরব বসন্তের ফুলঝুরি ছিটিয়ে আরব দেশগুলোতে নিজেদের পাপেট সরকার প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা কার্পণ্য করেনি। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসিকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের পছন্দের জেনারেল সিসিকে ক্ষমতায় বসায় তারা। নিজেরা মুখে মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র-শাসিত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহ বেশি তাদের। আমেরিকা তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতাকে না দেখার ভান করে, আবার কারও ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতার কিছু সত্য, তার চেয়েও বেশি অসত্য তথ্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়।

সেই আমেরিকা যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়, সেই উদ্যোগের উদ্দেশ্য নিয়ে তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে। যারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করবে, প্রভাবিত করবে, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হয়, এমন নির্দেশ দেবে, যারা সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে, তারা সবাই নাকি মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। কিন্তু ‘নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি’ প্রমাণিত হবে কীভাবে? আমেরিকা কাউকে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টিকারী সাব্যস্ত করলেই কি তিনি কথিত দোষে দুষ্ট হয়ে যাবেন? নাকি আমাদের বিচার বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত এতে বিবেচ্য হবে? নাকি আমাদের নির্বাচন কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত এতে কার্যকর হবে? নির্বাচনে পর্যবেক্ষণকারী এনজিওগুলোর এতে কী ভূমিকা থাকবে? তাদের কোনো পর্যবেক্ষণ কি কাউকে বাধা সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় ফেলবে? ভিসানীতি অনুসারে বাধা সৃষ্টিকারী সাব্যস্তের মোডাস-অপারেন্ডি কী হবে? যারা আমেরিকার ভিসা চাইছে না, জীবনেও আমেরিকা যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে না-এমন কিছু বা অনেক লোক কি নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টি করতে, বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না? যদি পারে, তাহলে সেখানে আমেরিকা আমাদের তেমন নির্বাচনকে কীভাবে দেখবে? তাদের ক্যাপিটল হিলে যে ট্রাম্পের সমর্থক হাজারো লোক উঠে গেল, তেমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারে না? তেমন কিছু ঘটলে এর বিরুদ্ধে ভিসানীতি কী কাজে আসবে?

তা ছাড়া সম্প্রতি নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডার ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতি কি আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে?

ভিসানীতির পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে? ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। অতীত ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দেয়, কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোতে আমেরিকার প্রথমে থাকে নিজের স্বার্থের প্রাধান্য। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যদি বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম অ্যাজেন্ডা হয়ে থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ববাদী রাজার শাসনাধীন দেশগুলোর জন্য কেন ভিসানীতির ঘোষণা আসে না? খুনের দায়ে অভিযুক্ত সৌদি যুবরাজ কীভাবে মার্কিন আনুগত্য পান?

এই ভিসানীতি যে বিশেষ মতলব থেকে করা, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। ভিসানীতি প্রয়োগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং অনধিকার চর্চা। বিষয়টিকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবেও দেখা যায়। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর। এই ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর কোয়াডে যুক্ত হওয়ার, মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সমঝোতা, জিসোমিয়া এবং আকসা চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে।

নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বিষয় নয়। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সামনে রেখে দেওয়া আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ঘোষিত উদ্দেশ্য যত মধুর শোনাক না কেন, এর অঘোষিত ও আসল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধে প্রবেশ করেছে আমেরিকা। আর এ বিরোধকে আমেরিকা গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের লড়াই হিসেবে চিত্রিত করছে, যা কিনা সততার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।

নিষেধাজ্ঞা কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, কিউবার ওপর ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও আমেরিকা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় কিউবা অনেক ধনী রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বিবিসি বাংলার খবর বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে।

তা ছাড়া, হুমকি দিয়ে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, ভীতি প্রদর্শন বা জোর করে কখনো কোনো দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না। বিশ্বের মোড়ল দেশটি এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য যে ভিসানীতি প্রয়োগ করছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটা কাউকেই সুবিধা দেবে না। বরং লেখাপড়া, ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি কিনে যারা আমেরিকায় বসতি গড়েছেন, কিংবা যারা বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেই এলিটদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা উদ্বেগ ও জটিলতা তৈরি করতে পারে।

সুষ্ঠু নির্বাচন রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার। সব দল চাইলে তা সহজেই সম্ভব। এ ব্যাপারে ভিসানীতি খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।

-লেখক ও গবেষক