ঢাকা ০১:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

নুরু ভাই : পণ্ডিতজনের বিদায়

মনজুরুল আহসান বুলবুল
  • আপডেট সময় : ১১:২৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৩৯৯ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ড. আ বা ম নুরুল আনোয়ার। অধ্যাপক নুরুল আনোয়ার। আমাদের নুরু ভাই। আড়ালে আবডালে সতীর্থরা বলতেন ‘নুরেন্দ্র নাথ ঠাকুর’। কেন, পরে বলছি। তিনি ছবি হয়ে গেলেন। একটা ভালো ছবি খুঁজে পেলাম না, ধার করলাম স্নেহভাজন পলাশের কাছ থেকে।

নুরু ভাইয়ের বিদায় একই সাথে বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চা, সংগীত ও ক্রিকেট জগতের একজন প্রকৃত পণ্ডিতজনের বিদায়। এই তিন বিষয়ে তিনি কত বড়মাপের পণ্ডিত ছিলেন তা নিয়ে আলোচনার যোগ্য মানুষ আমি নই।

তবে অনুধাবন করতে পারি। নুরু ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই পারি। আমরা তখন আমাদের উন্মাতাল যৌবন নিয়ে ছুটে বেড়াই জ্ঞানের অন্বেষণে। কোনো বিষয় বাদ নেই। মার্ক্সবাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, ক্রিকেট থেকে সমাজ বিপ্লব, সৃষ্টির অপার রহস্য থেকে বিজ্ঞান, ধর্ম আর দর্শনের অলিগলি। সবকিছুই জানতে চাই, সব নিয়ে বিতর্ক করি। এসব নিয়ে ‘মুক্ত বাতায়ন পাঠ চক্র’-এর সংস্কৃতি সপ্তাহ।

ঠিক হলো একদিন হবে বাংলা গান নিয়ে হবে আলোচনা। অবধারিতভাবে মূল আলোচক নুরু ভাই। প্রতিদিন আলোচনা শেষে মূল আকর্ষণ গান, নাচ বা অভিনয়। আমি অ-সুর প্রজাতির কিন্তু সাংগঠনিক কারণে লেগে থাকতে হয় সব কিছুতেই।

নির্ধারিত দিনে বাংলা গান নিয়ে আলোচনার সূচনা বক্তব্য দিলেন অধ্যাপক যতীন সরকার। এইবার অনুষ্ঠানের সূত্রধর আমি আহ্বান জানালাম নুরু ভাইকে। তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন। সাথে হারমোনিয়াম। দাঁড়িয়েই মুখভরা হাসি ছড়িয়ে বললেন—আমি আলোচনা করবো বাংলা গানের তিনশ বছরের ইতিহাস নিয়ে, কিছু গানও শোনাবো।

গান নিয়ে পাণ্ডিত্য আকাশছোঁয়া হলেও তার গানের গলা সময় চলতি শিল্পীদের মতো ছিল না। সেই তিনি শুরু করলেন। আমার পাশে বসা দুই বন্ধু অরুণ ভট্টাচার্য নয়ন এবং মাসুদ বিবাগী ( দুইজনেই আজ প্রয়াত) আমাকে খোঁচা দিয়ে বলছে—নুরু ভাই যদি তিনশ বছরের বছরওয়ারী একটা করে গানও গায় তাইলে আইজ বাড়িত যাওন লাগতো না, তুই সাধারণ সম্পাদক তুই শেষ পর্যন্ত থাহিস, আমরা নাই।

সবার আশঙ্কা সেই রকমই ছিল। কিন্তু অনেকের হয়তো বিশ্বাস হবে না, আড়াই-তিনঘণ্টার মধ্যে বাংলা গানের তিনশ বছরের বিবর্তন কিছু কথায়, কিছু তালে, কিছু সুরে নুরু ভাই সবাইকে আটকে রাখলেন।

বাংলা গান নিয়ে এমন কোনো আলোচনা আমি আর কোথাও শুনিনি। বাংলা লোকগানের প্রতিটি তাল, লয়, শব্দ যে সাধারণ বাঙালির জীবনেরই স্পন্দন তা নুরু ভাইয়ের সেইদিনের আলোচনা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।

তিনি তো রবীন্দ্রনাথের এনসাইক্লোপিডিয়া। আমার সাংবাদিকতা জীবনের নানা পর্বে রবীন্দ্রনাথের বহু বিষয় নিয়ে ঢাকার বহু পণ্ডিতদের নানা তথ্য নুরু ভাইয়ের কাছ থেকে আরেকবার ঝালিয়ে নিতাম। আমার লাভ হতো বিষয়টির নাড়ি নক্ষত্র জেনে আমি সমৃদ্ধ হতাম।

ক্রিকেটের কত বছরের তথ্য উপাত্ত যে তার মাথায় ছিল তা কল্পনা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। ময়মনসিংহের দাপুটে সাংবাদিক আমি, সহযোদ্ধা প্রণব রাউত। প্রণব রাউত সেই সময় ঢাকার বড় সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিকদের পাশাপাশি ক্রীড়া পর্যালোচনা লিখতেন।

নুরু ভাই পড়তেন এসব, পরামর্শও দিতেন। তার সাথে আড্ডায় বসলে রবীন্দ্রনাথ আর ক্রিকেটে ঘেরা থাকতো চারদিক। সেই রকম এক আড্ডায় তার বাসায় প্রণব রাউত আর আমি। নিবিষ্ট শ্রোতা পেলে নুরু ভাই ব্যাট করতেন হাত খুলে, চার-ছক্কার নিচে নয়। সেইদিনও তাই।

শুরু অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ দিয়ে, তারপর ক্রিকেটের পূর্বাপর তথ্য, পরিসংখ্যান, নানা দল, প্লেয়ার, মাঠ ও অ্যাম্পায়ারদের নিয়ে কত কথা। এইসব বলার সময় তার দেহভঙ্গি অদ্ভুত, যেন আমরা মাঠে বসে খেলা দেখছি। আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে বললেন—হুন, প্রথমবার লন্ডন গিয়া বিমান থাইক্যা নাইম্যাই ট্যাক্সি কইরা গেছি লর্ডসে, মাথা ছোঁয়াইয়া প্রণাম কইরা পরে গেছি অন্যকামে। ঐ যে কয়না লর্ডস হইলো ক্রিকেটের মক্কা। হা হা।

নুরু ভাইয়ের সেই অট্টহাসি। দুই ঘণ্টা একাই লাগাতার কথা। এক পর্যায়ে আমাদের উসখুস ভাব দেখে বললেন—তোমরা কি চা খাইবা? আমরা রাজি হলাম, এরও প্রায় আধাঘণ্টা পরে নুরু ভাইয়ের হাঁক, দিলরুবা, (ভাবির নাম) এই যে বুলবুল আর প্রণবরে চা খাওয়াইতা না। তারও ২০/২৫ মিনিট পরে ভাবির আবির্ভাব দৃশ্যপটে, চা খাইলে পাতা আনন লাগতো না।

অত্যন্ত সরলভাবে নুরু ভাইয়ের প্রস্তাব, লও যাই, মাচ্ছা বাজারে যাই, চা পাতা আনিগা। প্রণব দা আমাকে আস্তে করে বললেন, ভাগনে এইডাই ফাঁক, নাইলে চা পাতা আইন্যা বইলে দিন শ্যাষ। আমরা কেটে পড়ি নুরুভাইকে ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু আমাদের মাথায় গেঁথে থাকে রবীন্দ্রনাথ আর ক্রিকেটের অসাধারণ যুগলবন্দি, যার চিত্রকর আমাদের নুরু ভাই।

নুরু ভাই কোন ধরনের রাজনীতি করতেন জানি না, কিন্তু ময়মনসিংহ শহর আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনীতির আড্ডাগুলোর সাথে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। তার সব বন্ধুরা ছিলেন সেই জগতেরই।

রবীন্দ্রনাথ, সংগীত আর ক্রিকেট ছিল তার কাছে পবিত্র বিষয়। এসব প্রশ্নে তিনি আপস করতেন না।

আমরা মাঝে মধ্যে দুর্গাবাড়ি রোড বন্ধ করে মঞ্চ বানিয়ে আলোচনা আর নাচ, গানের অনুষ্ঠান করতাম। নুরু ভাই পছন্দ করতেন না। বলতেন, সংস্কৃতি হচ্ছে মন ও মননের বিষয়, মন তৈরি না করে মননে তা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে না, মগজেও না। রাস্তা বন্ধ করে অনুষ্ঠান করা যাবে কিন্তু লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। তার এই কথা সবাই মানতেন এমন হয়।

জীবিকার জন্য তিনি চাকরি করতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তার উপাসনায় ছিল রবীন্দ্রনাথ, সংগীত আর ক্রিকেট। তার মৃত্যুতে এই তিন জায়গায় কতটা ক্ষতি হলো তা পরিমাপের যোগ্য আমি নই। কিন্তু এইদেশ যে একজন খুবই বড়মাপের সংস্কৃতিবান নিখাদ ভালো মানুষকে হারালো তা নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করুক এই দাবি করি।

নুরু ভাই ছিলেন একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক ও ক্রীড়া সংগঠক। তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে অনেক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তৈরির মূল কারিগর। ছায়ানট ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা)’র সংগীত বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন।

তিনি ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনন্দধ্বনি ও শিশু তীর্থ নামে সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৪ অক্টোবর ২০২৩ বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তিনি পরপারে পাড়ি জমান।

নুরু ভাই আপনার অবিরাম আলোচনা থেকে পালাতে চাইতাম, আজ আর চাইলেও তা শুনতে পাবো না, এই কষ্ট নিয়েই কাটবে বাকি জীবন।

মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) bulbulahsan@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

নুরু ভাই : পণ্ডিতজনের বিদায়

আপডেট সময় : ১১:২৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩

ড. আ বা ম নুরুল আনোয়ার। অধ্যাপক নুরুল আনোয়ার। আমাদের নুরু ভাই। আড়ালে আবডালে সতীর্থরা বলতেন ‘নুরেন্দ্র নাথ ঠাকুর’। কেন, পরে বলছি। তিনি ছবি হয়ে গেলেন। একটা ভালো ছবি খুঁজে পেলাম না, ধার করলাম স্নেহভাজন পলাশের কাছ থেকে।

নুরু ভাইয়ের বিদায় একই সাথে বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চা, সংগীত ও ক্রিকেট জগতের একজন প্রকৃত পণ্ডিতজনের বিদায়। এই তিন বিষয়ে তিনি কত বড়মাপের পণ্ডিত ছিলেন তা নিয়ে আলোচনার যোগ্য মানুষ আমি নই।

তবে অনুধাবন করতে পারি। নুরু ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই পারি। আমরা তখন আমাদের উন্মাতাল যৌবন নিয়ে ছুটে বেড়াই জ্ঞানের অন্বেষণে। কোনো বিষয় বাদ নেই। মার্ক্সবাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, ক্রিকেট থেকে সমাজ বিপ্লব, সৃষ্টির অপার রহস্য থেকে বিজ্ঞান, ধর্ম আর দর্শনের অলিগলি। সবকিছুই জানতে চাই, সব নিয়ে বিতর্ক করি। এসব নিয়ে ‘মুক্ত বাতায়ন পাঠ চক্র’-এর সংস্কৃতি সপ্তাহ।

ঠিক হলো একদিন হবে বাংলা গান নিয়ে হবে আলোচনা। অবধারিতভাবে মূল আলোচক নুরু ভাই। প্রতিদিন আলোচনা শেষে মূল আকর্ষণ গান, নাচ বা অভিনয়। আমি অ-সুর প্রজাতির কিন্তু সাংগঠনিক কারণে লেগে থাকতে হয় সব কিছুতেই।

নির্ধারিত দিনে বাংলা গান নিয়ে আলোচনার সূচনা বক্তব্য দিলেন অধ্যাপক যতীন সরকার। এইবার অনুষ্ঠানের সূত্রধর আমি আহ্বান জানালাম নুরু ভাইকে। তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন। সাথে হারমোনিয়াম। দাঁড়িয়েই মুখভরা হাসি ছড়িয়ে বললেন—আমি আলোচনা করবো বাংলা গানের তিনশ বছরের ইতিহাস নিয়ে, কিছু গানও শোনাবো।

গান নিয়ে পাণ্ডিত্য আকাশছোঁয়া হলেও তার গানের গলা সময় চলতি শিল্পীদের মতো ছিল না। সেই তিনি শুরু করলেন। আমার পাশে বসা দুই বন্ধু অরুণ ভট্টাচার্য নয়ন এবং মাসুদ বিবাগী ( দুইজনেই আজ প্রয়াত) আমাকে খোঁচা দিয়ে বলছে—নুরু ভাই যদি তিনশ বছরের বছরওয়ারী একটা করে গানও গায় তাইলে আইজ বাড়িত যাওন লাগতো না, তুই সাধারণ সম্পাদক তুই শেষ পর্যন্ত থাহিস, আমরা নাই।

সবার আশঙ্কা সেই রকমই ছিল। কিন্তু অনেকের হয়তো বিশ্বাস হবে না, আড়াই-তিনঘণ্টার মধ্যে বাংলা গানের তিনশ বছরের বিবর্তন কিছু কথায়, কিছু তালে, কিছু সুরে নুরু ভাই সবাইকে আটকে রাখলেন।

বাংলা গান নিয়ে এমন কোনো আলোচনা আমি আর কোথাও শুনিনি। বাংলা লোকগানের প্রতিটি তাল, লয়, শব্দ যে সাধারণ বাঙালির জীবনেরই স্পন্দন তা নুরু ভাইয়ের সেইদিনের আলোচনা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।

তিনি তো রবীন্দ্রনাথের এনসাইক্লোপিডিয়া। আমার সাংবাদিকতা জীবনের নানা পর্বে রবীন্দ্রনাথের বহু বিষয় নিয়ে ঢাকার বহু পণ্ডিতদের নানা তথ্য নুরু ভাইয়ের কাছ থেকে আরেকবার ঝালিয়ে নিতাম। আমার লাভ হতো বিষয়টির নাড়ি নক্ষত্র জেনে আমি সমৃদ্ধ হতাম।

ক্রিকেটের কত বছরের তথ্য উপাত্ত যে তার মাথায় ছিল তা কল্পনা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। ময়মনসিংহের দাপুটে সাংবাদিক আমি, সহযোদ্ধা প্রণব রাউত। প্রণব রাউত সেই সময় ঢাকার বড় সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিকদের পাশাপাশি ক্রীড়া পর্যালোচনা লিখতেন।

নুরু ভাই পড়তেন এসব, পরামর্শও দিতেন। তার সাথে আড্ডায় বসলে রবীন্দ্রনাথ আর ক্রিকেটে ঘেরা থাকতো চারদিক। সেই রকম এক আড্ডায় তার বাসায় প্রণব রাউত আর আমি। নিবিষ্ট শ্রোতা পেলে নুরু ভাই ব্যাট করতেন হাত খুলে, চার-ছক্কার নিচে নয়। সেইদিনও তাই।

শুরু অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ দিয়ে, তারপর ক্রিকেটের পূর্বাপর তথ্য, পরিসংখ্যান, নানা দল, প্লেয়ার, মাঠ ও অ্যাম্পায়ারদের নিয়ে কত কথা। এইসব বলার সময় তার দেহভঙ্গি অদ্ভুত, যেন আমরা মাঠে বসে খেলা দেখছি। আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে বললেন—হুন, প্রথমবার লন্ডন গিয়া বিমান থাইক্যা নাইম্যাই ট্যাক্সি কইরা গেছি লর্ডসে, মাথা ছোঁয়াইয়া প্রণাম কইরা পরে গেছি অন্যকামে। ঐ যে কয়না লর্ডস হইলো ক্রিকেটের মক্কা। হা হা।

নুরু ভাইয়ের সেই অট্টহাসি। দুই ঘণ্টা একাই লাগাতার কথা। এক পর্যায়ে আমাদের উসখুস ভাব দেখে বললেন—তোমরা কি চা খাইবা? আমরা রাজি হলাম, এরও প্রায় আধাঘণ্টা পরে নুরু ভাইয়ের হাঁক, দিলরুবা, (ভাবির নাম) এই যে বুলবুল আর প্রণবরে চা খাওয়াইতা না। তারও ২০/২৫ মিনিট পরে ভাবির আবির্ভাব দৃশ্যপটে, চা খাইলে পাতা আনন লাগতো না।

অত্যন্ত সরলভাবে নুরু ভাইয়ের প্রস্তাব, লও যাই, মাচ্ছা বাজারে যাই, চা পাতা আনিগা। প্রণব দা আমাকে আস্তে করে বললেন, ভাগনে এইডাই ফাঁক, নাইলে চা পাতা আইন্যা বইলে দিন শ্যাষ। আমরা কেটে পড়ি নুরুভাইকে ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু আমাদের মাথায় গেঁথে থাকে রবীন্দ্রনাথ আর ক্রিকেটের অসাধারণ যুগলবন্দি, যার চিত্রকর আমাদের নুরু ভাই।

নুরু ভাই কোন ধরনের রাজনীতি করতেন জানি না, কিন্তু ময়মনসিংহ শহর আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনীতির আড্ডাগুলোর সাথে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। তার সব বন্ধুরা ছিলেন সেই জগতেরই।

রবীন্দ্রনাথ, সংগীত আর ক্রিকেট ছিল তার কাছে পবিত্র বিষয়। এসব প্রশ্নে তিনি আপস করতেন না।

আমরা মাঝে মধ্যে দুর্গাবাড়ি রোড বন্ধ করে মঞ্চ বানিয়ে আলোচনা আর নাচ, গানের অনুষ্ঠান করতাম। নুরু ভাই পছন্দ করতেন না। বলতেন, সংস্কৃতি হচ্ছে মন ও মননের বিষয়, মন তৈরি না করে মননে তা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে না, মগজেও না। রাস্তা বন্ধ করে অনুষ্ঠান করা যাবে কিন্তু লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। তার এই কথা সবাই মানতেন এমন হয়।

জীবিকার জন্য তিনি চাকরি করতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তার উপাসনায় ছিল রবীন্দ্রনাথ, সংগীত আর ক্রিকেট। তার মৃত্যুতে এই তিন জায়গায় কতটা ক্ষতি হলো তা পরিমাপের যোগ্য আমি নই। কিন্তু এইদেশ যে একজন খুবই বড়মাপের সংস্কৃতিবান নিখাদ ভালো মানুষকে হারালো তা নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করুক এই দাবি করি।

নুরু ভাই ছিলেন একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক ও ক্রীড়া সংগঠক। তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে অনেক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তৈরির মূল কারিগর। ছায়ানট ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা)’র সংগীত বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন।

তিনি ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনন্দধ্বনি ও শিশু তীর্থ নামে সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৪ অক্টোবর ২০২৩ বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তিনি পরপারে পাড়ি জমান।

নুরু ভাই আপনার অবিরাম আলোচনা থেকে পালাতে চাইতাম, আজ আর চাইলেও তা শুনতে পাবো না, এই কষ্ট নিয়েই কাটবে বাকি জীবন।

মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) bulbulahsan@gmail.com