ঢাকা ১২:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

জন্মের পাপ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অসমাপ্ত যুদ্ধ

চিররঞ্জন সরকার
  • আপডেট সময় : ০৬:৪১:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৪৪৩ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এ যেন মৃত্যুরই উৎসব। প্রতিদিন অকাতরে শয়ে শয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে হামাসের হামলা এবং ইসরায়েলের প্রত্যাঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে তিন হাজারেরও বেশি বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এর আগে ইসরায়েলের তরফে জানানো হয়েছিল, হামাসের হামলায় তাদের এক হাজারেরও বেশি নাগরিক মারা গেছে। গাজার স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে জানানো হয়, ৮৩০ জন বাসিন্দা ইসরায়েলি হামলায় মারা গেছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে চলেছে। গত শনিবার থেকে গাজায় ঘরছাড়া ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ জন। তাঁরা এখন আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরগুলিতে। তাঁদের মধ্যে তিন হাজার মানুষ ইসরায়েল-হামাসের সংঘর্ষের কারণে আগে থেকেই ঘরছাড়া।
আমরা জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের কথা শুনছি। এখনো চলছে সেই যুদ্ধ। গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর ভূগোল পাল্টে গেলেও বদলায়নি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি বৈরিতা। কমেনি ইসরায়েলিদের প্রতি ফিলিস্তিনিদের পূঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে জন্ম নেওয়া হিংসা।

প্রতিনিয়ত হামলা-নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের প্রতি ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। মানুষকে জোর করে অবরুদ্ধ রাখলে, নিপীড়ন চালালে এক সময় তার বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভেরই অনিবার্য প্রকাশ। ইসরায়েলে ক্ষমতাসীন নেতানিয়াহু সরকারের আমলে গাজাসহ ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর লাগাতার সামরিক আক্রমণের উত্তরে বহু দিন ধরে পরিকল্পিত এমন হামলা।

এ হামলা ফিলিস্তিনিদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নিশ্চিতভাবেই সমুচিত জবাব দেবে ইসরায়েল, যাতে আরও বহু নিরীহ ফিলিস্তিনির প্রাণ যাবে। ইতিমধ্যে যার আলামত শুরু হয়ে গেছে। খর্ব-শক্তির ফিলিস্তিনের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিধর (অঘোষিত) ইসরায়েলের এই সংঘাত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাতের অবসান কবে হবে? আর কত নিরীহ প্রাণ বলি হবে?

ইতিহাসের দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৮-এ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই তা ফিলিস্তিন তথা আরব দুনিয়ার সঙ্গে (মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে) বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অথচ বিশ শতকের প্রথমদিকেও ফিলিস্তিন ও ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ১৯২০ সালের ফ্রান্স-সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার পরাজয়ের পর এই শান্তি ক্রমশ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের এই পর্বের অন্যতম রূপকার হজ আমিন আল হুসেইনি ফিলিস্তিনি আরবদের নিজস্ব দেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন।

এই সময়েই ইউরোপে ফ্যাসিস্টদের ইহুদি বিতাড়ন ও নিপীড়নের অধ্যায় শুরু হলে তারা ফিলিস্তিনে চলে আসতে থাকে। ফিলিস্তিনে বাড়তে থাকা ইসরায়েলি জনসংখ্যার চাপের পরিপ্রেক্ষিতে আরব ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশের দাবি সংকটজনক হয়ে উঠছে বিবেচনা করে আমিন হুসেইনি ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনকে আরব ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন।

বিভিন্ন আরব দেশে আরব ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের সমর্থন তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ফিলিস্তিনি ইহুদি ও ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে জার্মানিসহ নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক ইহুদি বিতাড়ন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ইউরোপের অনেক দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের পুনর্বাসনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে তিনভাগ করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যার একটি হবে আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও আলাদা অঞ্চল হিসেবে থাকবে জেরুজালেম, যে ঐতিহাসিক শহর ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম– এই তিন ধর্মেরই মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান।

এই ঘোষণার পরদিন থেকেই আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ইসরায়েলের বর্তমান আগ্রাসী ভূমিকা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুললেও এই রাষ্ট্রটির জন্ম-ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে সংকটের বীজ। বিস্ময়কর হচ্ছে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র আমেরিকা কিন্তু ইসরায়েলের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ব্রিটিশরা ইসরায়েল ছাড়ার দুদিন আগেও (মানে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার দুদিন আগে) আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং স্টেট সেক্রেটারি জর্জ মার্শাল ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ইসরায়েলকে মেনে নিতে চাইছিলেন না মার্শাল। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের জন্ম হলে অশান্ত হবে মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ হবেই।

এমন অবস্থায় ফিলিস্তিনে অবস্থানরত ব্রিটিশদের আর মাত্র দুদিন হাতে ছিল (১৪ মে, ১৯৪৮)। এ সময় বেন গ্রুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে দূত পাঠালেন ইসরায়েলের স্বীকৃতির জন্য। ট্রুম্যান ইহুদি ভোটব্যাংকের কথা বিবেচনা করে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে চাইলেন। মার্শাল এসব শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ট্রুম্যানের কাছে জানতে চাইলেন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ তিনি চাইছেন কি না। ট্রুম্যান এত কিছু শুনলেন না। তিনি জানিয়ে দেন, আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।

সবার আগে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সব কমিউনিস্ট দেশ। শুধু তাই নয়, প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যেটাতে হারলে ইসরায়েল শেষ হয়ে যেত, সেই যুদ্ধে ইসরায়েলকে অস্ত্র সাহায্য করে চেকোশ্লোভাকিয়াসহ সোভিয়েত ব্লক। আমেরিকা তখন ইসরায়েলের ওপর ‘অবরোধ’ চাপিয়েছিল। তবে ইসরায়েল গঠনের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওখানকার ইহুদি লবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের যেসব অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত, তা ব্রিটিশদের করায়ত্তে আসে। এর মধ্যে একটা ছিল ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন। ১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে।

১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটস চাইল্ডকে। এতেই সেই বিতর্কিত ‘ন্যাশানাল হোম ফর জুয়িশ পিপলের’ কথা আছে।

১৯৪৮-এর অনেক পরের কথা। এর মাঝে দফায় দফায় বড় সংখ্যায় ইহুদি অভিবাসন হয়েছে ফিলিস্তিনে, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে। এতে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার হিসাব বদলেছে এবং আরব-ইহুদি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। হিটলার জার্মানি থেকে এই অভিবাসন উৎসাহিত করেছিলেন, জায়নিস্ট ফেডারেশন অব জার্মানির সঙ্গে হাভারা চুক্তি করে। এতে কথা হয়েছিল ইহুদিরা যদি জার্মানিতে তাদের সব সম্পত্তি ছেড়ে ফিলিস্তিনে চলে যায়, তার পরিবর্তে তারা ওইসব জিনিসের ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে ফিলিস্তিনে বসে, ঠিক জার্মান রপ্তানি পণ্যের মতো।

ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য কে আসলে দায়ী, এই আলোচনায় উল্লিখিত ভূমিকাটা বাদ দিলে আসল ব্যাপারটা হারিয়ে যায়। এর পর ভলগা-যমুনায় বহু জল গড়িয়েছে। ১৯৪৮-এ যুযুধান দুই পক্ষ (ইসরায়েল ও ব্রিটেন) এখন এক টেবিলে খায়। জিওপলিটিক্সের গতি মেসি-নেইমারের ডজের মতোই চপল। এই ডান দিক তো এই বাঁ দিক। কেউ কারও স্থায়ী শত্রু নয়, কেউ কারও স্থায়ী বন্ধু নয়। যে আমেরিকা একদিন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল, আজ তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে অন্য দেশে বোমা ফেলে। তবে ব্রিটিশদের হাতে রোপিত বিষবৃক্ষগুলো এখন আমেরিকার পরিচর্যায় মহিরুহে পরিণত হয়েছে।

এটা স্পষ্ট আরব ফিলিস্তিনিদের জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। ইসরায়েল মার্কিন ন্যাটো অক্ষ কিছুতেই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জাতিসংঘে সদস্যপদসহ আরব ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘকালের ন্যায্য দাবিকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এই প্রত্যাখ্যানই সশস্ত্র আক্রমণের দিকে ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দেয় এবং একে অজুহাত করে ইসরায়েল ন্যাটো মার্কিন অক্ষের সমর্থনে পাল্টা হামলা চালায়।

বস্তুতপক্ষে, ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়ায় মার্কিন অক্ষ নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখেছে। তবে এবার যেভাবে দুপক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথে এগোচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ তার ধামাধারী গোষ্ঠী যেভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন, তাতে রক্তক্ষয়ের নয়া পর্বের সূচনা হতে পারে এই এলাকায়! যুদ্ধবাজ স্বার্থান্ধ ‘উন্মাদ’দের কারণে মানবজাতিকে আর কতবার রক্তগঙ্গায় ভাসতে হবে, এটাই প্রশ্ন!

নিউজটি শেয়ার করুন

জন্মের পাপ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অসমাপ্ত যুদ্ধ

আপডেট সময় : ০৬:৪১:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩

এ যেন মৃত্যুরই উৎসব। প্রতিদিন অকাতরে শয়ে শয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে হামাসের হামলা এবং ইসরায়েলের প্রত্যাঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে তিন হাজারেরও বেশি বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এর আগে ইসরায়েলের তরফে জানানো হয়েছিল, হামাসের হামলায় তাদের এক হাজারেরও বেশি নাগরিক মারা গেছে। গাজার স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে জানানো হয়, ৮৩০ জন বাসিন্দা ইসরায়েলি হামলায় মারা গেছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে চলেছে। গত শনিবার থেকে গাজায় ঘরছাড়া ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ জন। তাঁরা এখন আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরগুলিতে। তাঁদের মধ্যে তিন হাজার মানুষ ইসরায়েল-হামাসের সংঘর্ষের কারণে আগে থেকেই ঘরছাড়া।
আমরা জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের কথা শুনছি। এখনো চলছে সেই যুদ্ধ। গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর ভূগোল পাল্টে গেলেও বদলায়নি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি বৈরিতা। কমেনি ইসরায়েলিদের প্রতি ফিলিস্তিনিদের পূঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে জন্ম নেওয়া হিংসা।

প্রতিনিয়ত হামলা-নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের প্রতি ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। মানুষকে জোর করে অবরুদ্ধ রাখলে, নিপীড়ন চালালে এক সময় তার বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভেরই অনিবার্য প্রকাশ। ইসরায়েলে ক্ষমতাসীন নেতানিয়াহু সরকারের আমলে গাজাসহ ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর লাগাতার সামরিক আক্রমণের উত্তরে বহু দিন ধরে পরিকল্পিত এমন হামলা।

এ হামলা ফিলিস্তিনিদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নিশ্চিতভাবেই সমুচিত জবাব দেবে ইসরায়েল, যাতে আরও বহু নিরীহ ফিলিস্তিনির প্রাণ যাবে। ইতিমধ্যে যার আলামত শুরু হয়ে গেছে। খর্ব-শক্তির ফিলিস্তিনের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিধর (অঘোষিত) ইসরায়েলের এই সংঘাত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাতের অবসান কবে হবে? আর কত নিরীহ প্রাণ বলি হবে?

ইতিহাসের দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৮-এ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই তা ফিলিস্তিন তথা আরব দুনিয়ার সঙ্গে (মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে) বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অথচ বিশ শতকের প্রথমদিকেও ফিলিস্তিন ও ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ১৯২০ সালের ফ্রান্স-সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার পরাজয়ের পর এই শান্তি ক্রমশ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের এই পর্বের অন্যতম রূপকার হজ আমিন আল হুসেইনি ফিলিস্তিনি আরবদের নিজস্ব দেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন।

এই সময়েই ইউরোপে ফ্যাসিস্টদের ইহুদি বিতাড়ন ও নিপীড়নের অধ্যায় শুরু হলে তারা ফিলিস্তিনে চলে আসতে থাকে। ফিলিস্তিনে বাড়তে থাকা ইসরায়েলি জনসংখ্যার চাপের পরিপ্রেক্ষিতে আরব ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশের দাবি সংকটজনক হয়ে উঠছে বিবেচনা করে আমিন হুসেইনি ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনকে আরব ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন।

বিভিন্ন আরব দেশে আরব ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আন্দোলনের সমর্থন তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ফিলিস্তিনি ইহুদি ও ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে জার্মানিসহ নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক ইহুদি বিতাড়ন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ইউরোপের অনেক দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের পুনর্বাসনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে তিনভাগ করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যার একটি হবে আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও আলাদা অঞ্চল হিসেবে থাকবে জেরুজালেম, যে ঐতিহাসিক শহর ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম– এই তিন ধর্মেরই মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান।

এই ঘোষণার পরদিন থেকেই আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ইসরায়েলের বর্তমান আগ্রাসী ভূমিকা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুললেও এই রাষ্ট্রটির জন্ম-ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে সংকটের বীজ। বিস্ময়কর হচ্ছে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র আমেরিকা কিন্তু ইসরায়েলের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ব্রিটিশরা ইসরায়েল ছাড়ার দুদিন আগেও (মানে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার দুদিন আগে) আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং স্টেট সেক্রেটারি জর্জ মার্শাল ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ইসরায়েলকে মেনে নিতে চাইছিলেন না মার্শাল। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের জন্ম হলে অশান্ত হবে মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ হবেই।

এমন অবস্থায় ফিলিস্তিনে অবস্থানরত ব্রিটিশদের আর মাত্র দুদিন হাতে ছিল (১৪ মে, ১৯৪৮)। এ সময় বেন গ্রুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে দূত পাঠালেন ইসরায়েলের স্বীকৃতির জন্য। ট্রুম্যান ইহুদি ভোটব্যাংকের কথা বিবেচনা করে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে চাইলেন। মার্শাল এসব শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ট্রুম্যানের কাছে জানতে চাইলেন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ তিনি চাইছেন কি না। ট্রুম্যান এত কিছু শুনলেন না। তিনি জানিয়ে দেন, আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।

সবার আগে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সব কমিউনিস্ট দেশ। শুধু তাই নয়, প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যেটাতে হারলে ইসরায়েল শেষ হয়ে যেত, সেই যুদ্ধে ইসরায়েলকে অস্ত্র সাহায্য করে চেকোশ্লোভাকিয়াসহ সোভিয়েত ব্লক। আমেরিকা তখন ইসরায়েলের ওপর ‘অবরোধ’ চাপিয়েছিল। তবে ইসরায়েল গঠনের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওখানকার ইহুদি লবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের যেসব অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত, তা ব্রিটিশদের করায়ত্তে আসে। এর মধ্যে একটা ছিল ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন। ১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে।

১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটস চাইল্ডকে। এতেই সেই বিতর্কিত ‘ন্যাশানাল হোম ফর জুয়িশ পিপলের’ কথা আছে।

১৯৪৮-এর অনেক পরের কথা। এর মাঝে দফায় দফায় বড় সংখ্যায় ইহুদি অভিবাসন হয়েছে ফিলিস্তিনে, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে। এতে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার হিসাব বদলেছে এবং আরব-ইহুদি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। হিটলার জার্মানি থেকে এই অভিবাসন উৎসাহিত করেছিলেন, জায়নিস্ট ফেডারেশন অব জার্মানির সঙ্গে হাভারা চুক্তি করে। এতে কথা হয়েছিল ইহুদিরা যদি জার্মানিতে তাদের সব সম্পত্তি ছেড়ে ফিলিস্তিনে চলে যায়, তার পরিবর্তে তারা ওইসব জিনিসের ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে ফিলিস্তিনে বসে, ঠিক জার্মান রপ্তানি পণ্যের মতো।

ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য কে আসলে দায়ী, এই আলোচনায় উল্লিখিত ভূমিকাটা বাদ দিলে আসল ব্যাপারটা হারিয়ে যায়। এর পর ভলগা-যমুনায় বহু জল গড়িয়েছে। ১৯৪৮-এ যুযুধান দুই পক্ষ (ইসরায়েল ও ব্রিটেন) এখন এক টেবিলে খায়। জিওপলিটিক্সের গতি মেসি-নেইমারের ডজের মতোই চপল। এই ডান দিক তো এই বাঁ দিক। কেউ কারও স্থায়ী শত্রু নয়, কেউ কারও স্থায়ী বন্ধু নয়। যে আমেরিকা একদিন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল, আজ তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে অন্য দেশে বোমা ফেলে। তবে ব্রিটিশদের হাতে রোপিত বিষবৃক্ষগুলো এখন আমেরিকার পরিচর্যায় মহিরুহে পরিণত হয়েছে।

এটা স্পষ্ট আরব ফিলিস্তিনিদের জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। ইসরায়েল মার্কিন ন্যাটো অক্ষ কিছুতেই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জাতিসংঘে সদস্যপদসহ আরব ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘকালের ন্যায্য দাবিকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এই প্রত্যাখ্যানই সশস্ত্র আক্রমণের দিকে ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দেয় এবং একে অজুহাত করে ইসরায়েল ন্যাটো মার্কিন অক্ষের সমর্থনে পাল্টা হামলা চালায়।

বস্তুতপক্ষে, ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়ায় মার্কিন অক্ষ নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখেছে। তবে এবার যেভাবে দুপক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথে এগোচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ তার ধামাধারী গোষ্ঠী যেভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন, তাতে রক্তক্ষয়ের নয়া পর্বের সূচনা হতে পারে এই এলাকায়! যুদ্ধবাজ স্বার্থান্ধ ‘উন্মাদ’দের কারণে মানবজাতিকে আর কতবার রক্তগঙ্গায় ভাসতে হবে, এটাই প্রশ্ন!