ঢাকা ০১:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ফিলিস্তিনিদের নিয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে

মারুফ ইসলাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৪০:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৩৯০ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গাজায় শুধু হামাস যোদ্ধারা অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়েই যুদ্ধ করছে তা নয়। ফিলিস্তিনিরা আরও একটি যুদ্ধ করছে, যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা নেই কোথাও। কী সেই যুদ্ধ, তা জানার আগে গোটা বিশ্বের দিকে একবার নজর বুলাতে হবে।

ইদানীং কানাডার টরন্টো থেকে জার্মানির বার্লিন পর্যন্ত ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে’ স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়েছে। এমনকি আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে পর্যন্ত দেখা গেছে স্লোগানটি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকনোমিস্ট বলছে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষার্থীদের ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে’ স্লোগান দিতে দিতে করিডোর ধরে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।

কী অর্থ বহন করে এই সব দৃশ্য? এর অর্থ হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধ শুধু ফিলিস্তিনে সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। যুদ্ধটি সীমাবদ্ধ নেই শুধু অস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে, তা রূপ নিয়েছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধেও। ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে—কয়েক দশকের পুরনো এই স্লোগাটির পক্ষে জনমত পোক্ত হচ্ছে।

যারা গভীরভাবে এই সব দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, মার্কিনিদের মনস্তত্ত্বে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঘৃণাবিরোধী মার্কিন গ্রুপ অ্যান্টি ডিফামেশন লিগের পরিচালক জোনাথন গ্রিনব্ল্যাট বলেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ঘিরে পশ্চিমাদের মনোভাব আর আগের মতো নেই। ইহুদি বিরোধীতা বেড়েছে এবং বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন বেড়েছে। এর পেছনে তিনটি শক্তি কাজ করেছে—প্রযুক্তি, জনসংখ্যা ও আদর্শ।

বিষয়গুলো একটু বিশদে ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমেই প্রযুক্তরি কথা বলি। প্রযুক্তির উল্লফনের কারণে সারা পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য তথ্যের পাশাপাশি মিথ্যা তথ্যেরও জোয়ার চলছে। চলমান এই ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধের সময়ে অনেক পুরনো ছবি, ভুয়া ছবি, সম্পাদিত ছবি এবং ভিডিও গেম থেকে নেওয়া ছবি ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এটিও এক যুদ্ধ বটে। এসব বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে সত্য তথ্য নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে হামাস ও ইসরায়েল—উভয় পক্ষকেই।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে জনসংখ্যা। অভিবাসনসহ আরও নানা কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে। পশ্চিম জার্মানির এসেন্সে অবস্থিত সেন্টার ফর তুর্কি স্টাডিজ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন রিসার্চের গবেষক ইউনুস উলুসয় বলেন, জার্মানিতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রধানত তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিল। এখন জার্মানির ২১ লাখ মুসলমানের মধ্যে বেশির ভাগেই এসেছে সিরিয়া, ইরাক ও ফিলিস্তিন থেকে। এই মুসলিমরা শুধু রক্ত মাংসের শরীর নিয়েই আসেনি, সঙ্গে করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও নিয়ে এসেছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোই এখন ডালপালা মেলছে জার্মানির সমগ্র আকাশে।

১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনিরা সংখ্যায় চারগুন বেড়েছে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কোনও ইহুদি নেই। এমনকি গোটা আরবেই ইহুদি নেই। কিন্তু খোদ ইসরায়েলে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই আরবের। এই বিপুল সংখ্যক আরব জনগোষ্ঠী চেতনে কিংবা অবচেতনে তাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধটা কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, আমেরিকায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষে বেশি সমর্থন দেখা গেলেও মার্কিন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ক্রমশ কমছে। তারা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। তারই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে আমেরিকার পথে ঘাটে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের মাধ্যমে।

আমেরিকায় আরেকটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে। সেটি হচ্ছে—নিরবতাই সহিংসতা। অর্থাৎ নিরব থাকা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাই সরব হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা বলছে, ইউক্রেন যেমন প্রতিবেশি দেশ রাশিয়ার দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে, তেমনি গাজা তার প্রতিবেশি ইসরায়েল দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সমর্থকেরা বলছে, রাশিয়া যেমন ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ করছে, তেমনি হামাসও ইসরায়েলের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। এই যে বাকযুদ্ধ, এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে, জানা নেই।

এবার আদর্শ বিষয়ে বলি। আদর্শিক কারণে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে আমেরিকার নাগরিকদের একটা বড় অংশ ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ্রর পেছনে গাজার অসহায় মানুষদের প্রতি সহানুভূতিই বেশি কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লষকেরা। রাষ্ট্র ও জনগণ স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোয় মুসলিম ভোটারদের দাপট বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমতে শুরু করেছে।

সবকিছু মিলিয়ে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের বাস্তব যুদ্ধ আর সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এখন আর আলাদা কিছু নয়। উভয় যুদ্ধই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। গাজাবাসীর দুর্দশা নিয়ে সারা পৃথিবীর লেখক–শিল্পী–সাহিত্যিক–অভিনেতা–অভিনেত্রী–মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, এমনটি ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

বিশ্বের শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে ইতিমধ্যেই খোলা চিঠি লিখেছেন। পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে হাজার হাজার ফিলিস্তিন সমর্থকেরা সমাবেশ করেছে, যা এর আগে কল্পনাও করা যেত না।

পশ্চিমা বামরা এক সময় ইহুদিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। সেই মনোভাবের পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ছয় দিনের যুদ্ধের পর, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা যখন ইসরায়েলি বাহিনী যখন দখল করে নেয়, তখন থেকে। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসান হয়ে যাওয়াও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

ইউরোপেও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে। যাঁরা নিয়মিত ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি দেখে থাকেন, তাঁরা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করতে বেশ অনীহাই দেখাচ্ছে বিবিসি।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলাম লেখক টানয়া গোল্ড বলেন, সাংস্কৃতিক যুদ্ধের নানা ধরন রয়েছে। যেমন ইহুদি–মুসলিম, বামপন্থী–ডানপন্থী, তরুণ–বৃদ্ধ ইত্যাদি। এসব যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো সম্ভবত ইহুদি ও মুসলিমদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। ইউরোপে অন্তত ২০০ বছর ইহুদিভীতি জারি ছিল। এখন ইহুদিবিদ্বেষ যখন শনৈ শনৈ বাড়ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভক্তি বাড়ছে।

উদার গণতান্ত্রিক উত্তর আধুনিক এই একুশ শতকের দুনিয়ায় এসব বিভাজনপ্রিয় যুদ্ধের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। তবে যুদ্ধটা যে এখনও জারি রয়েছে, সেই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

ফিলিস্তিনিদের নিয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে

আপডেট সময় : ০৬:৪০:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ নভেম্বর ২০২৩

গাজায় শুধু হামাস যোদ্ধারা অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়েই যুদ্ধ করছে তা নয়। ফিলিস্তিনিরা আরও একটি যুদ্ধ করছে, যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা নেই কোথাও। কী সেই যুদ্ধ, তা জানার আগে গোটা বিশ্বের দিকে একবার নজর বুলাতে হবে।

ইদানীং কানাডার টরন্টো থেকে জার্মানির বার্লিন পর্যন্ত ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে’ স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়েছে। এমনকি আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে পর্যন্ত দেখা গেছে স্লোগানটি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকনোমিস্ট বলছে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষার্থীদের ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে’ স্লোগান দিতে দিতে করিডোর ধরে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।

কী অর্থ বহন করে এই সব দৃশ্য? এর অর্থ হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধ শুধু ফিলিস্তিনে সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। যুদ্ধটি সীমাবদ্ধ নেই শুধু অস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে, তা রূপ নিয়েছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধেও। ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে—কয়েক দশকের পুরনো এই স্লোগাটির পক্ষে জনমত পোক্ত হচ্ছে।

যারা গভীরভাবে এই সব দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, মার্কিনিদের মনস্তত্ত্বে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঘৃণাবিরোধী মার্কিন গ্রুপ অ্যান্টি ডিফামেশন লিগের পরিচালক জোনাথন গ্রিনব্ল্যাট বলেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ঘিরে পশ্চিমাদের মনোভাব আর আগের মতো নেই। ইহুদি বিরোধীতা বেড়েছে এবং বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন বেড়েছে। এর পেছনে তিনটি শক্তি কাজ করেছে—প্রযুক্তি, জনসংখ্যা ও আদর্শ।

বিষয়গুলো একটু বিশদে ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমেই প্রযুক্তরি কথা বলি। প্রযুক্তির উল্লফনের কারণে সারা পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য তথ্যের পাশাপাশি মিথ্যা তথ্যেরও জোয়ার চলছে। চলমান এই ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধের সময়ে অনেক পুরনো ছবি, ভুয়া ছবি, সম্পাদিত ছবি এবং ভিডিও গেম থেকে নেওয়া ছবি ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এটিও এক যুদ্ধ বটে। এসব বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে সত্য তথ্য নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে হামাস ও ইসরায়েল—উভয় পক্ষকেই।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে জনসংখ্যা। অভিবাসনসহ আরও নানা কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে। পশ্চিম জার্মানির এসেন্সে অবস্থিত সেন্টার ফর তুর্কি স্টাডিজ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন রিসার্চের গবেষক ইউনুস উলুসয় বলেন, জার্মানিতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রধানত তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিল। এখন জার্মানির ২১ লাখ মুসলমানের মধ্যে বেশির ভাগেই এসেছে সিরিয়া, ইরাক ও ফিলিস্তিন থেকে। এই মুসলিমরা শুধু রক্ত মাংসের শরীর নিয়েই আসেনি, সঙ্গে করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও নিয়ে এসেছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোই এখন ডালপালা মেলছে জার্মানির সমগ্র আকাশে।

১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনিরা সংখ্যায় চারগুন বেড়েছে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কোনও ইহুদি নেই। এমনকি গোটা আরবেই ইহুদি নেই। কিন্তু খোদ ইসরায়েলে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই আরবের। এই বিপুল সংখ্যক আরব জনগোষ্ঠী চেতনে কিংবা অবচেতনে তাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধটা কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, আমেরিকায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষে বেশি সমর্থন দেখা গেলেও মার্কিন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ক্রমশ কমছে। তারা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। তারই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে আমেরিকার পথে ঘাটে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের মাধ্যমে।

আমেরিকায় আরেকটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে। সেটি হচ্ছে—নিরবতাই সহিংসতা। অর্থাৎ নিরব থাকা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাই সরব হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা বলছে, ইউক্রেন যেমন প্রতিবেশি দেশ রাশিয়ার দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে, তেমনি গাজা তার প্রতিবেশি ইসরায়েল দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সমর্থকেরা বলছে, রাশিয়া যেমন ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ করছে, তেমনি হামাসও ইসরায়েলের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। এই যে বাকযুদ্ধ, এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে, জানা নেই।

এবার আদর্শ বিষয়ে বলি। আদর্শিক কারণে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে আমেরিকার নাগরিকদের একটা বড় অংশ ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ্রর পেছনে গাজার অসহায় মানুষদের প্রতি সহানুভূতিই বেশি কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লষকেরা। রাষ্ট্র ও জনগণ স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোয় মুসলিম ভোটারদের দাপট বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমতে শুরু করেছে।

সবকিছু মিলিয়ে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের বাস্তব যুদ্ধ আর সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এখন আর আলাদা কিছু নয়। উভয় যুদ্ধই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। গাজাবাসীর দুর্দশা নিয়ে সারা পৃথিবীর লেখক–শিল্পী–সাহিত্যিক–অভিনেতা–অভিনেত্রী–মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, এমনটি ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

বিশ্বের শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে ইতিমধ্যেই খোলা চিঠি লিখেছেন। পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে হাজার হাজার ফিলিস্তিন সমর্থকেরা সমাবেশ করেছে, যা এর আগে কল্পনাও করা যেত না।

পশ্চিমা বামরা এক সময় ইহুদিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। সেই মনোভাবের পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ছয় দিনের যুদ্ধের পর, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা যখন ইসরায়েলি বাহিনী যখন দখল করে নেয়, তখন থেকে। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসান হয়ে যাওয়াও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

ইউরোপেও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে। যাঁরা নিয়মিত ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি দেখে থাকেন, তাঁরা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করতে বেশ অনীহাই দেখাচ্ছে বিবিসি।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলাম লেখক টানয়া গোল্ড বলেন, সাংস্কৃতিক যুদ্ধের নানা ধরন রয়েছে। যেমন ইহুদি–মুসলিম, বামপন্থী–ডানপন্থী, তরুণ–বৃদ্ধ ইত্যাদি। এসব যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো সম্ভবত ইহুদি ও মুসলিমদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। ইউরোপে অন্তত ২০০ বছর ইহুদিভীতি জারি ছিল। এখন ইহুদিবিদ্বেষ যখন শনৈ শনৈ বাড়ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভক্তি বাড়ছে।

উদার গণতান্ত্রিক উত্তর আধুনিক এই একুশ শতকের দুনিয়ায় এসব বিভাজনপ্রিয় যুদ্ধের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। তবে যুদ্ধটা যে এখনও জারি রয়েছে, সেই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।